ভাঙন আতঙ্কে কুষ্টিয়ার পদ্মা পাড়ে নির্ঘুম রাত

আনিস মণ্ডল, কুষ্টিয়া

সন্ধ্যা নেমেছে পদ্মা পাড়ে। ঘরে ফিরছে পশুপাখি। শান্ত সন্ধ্যায় ধীরে ধীরে নিজেকে গুঁটিয়ে নিচ্ছে প্রকৃতি। কিন্তু তখনো ঘরে ফেরার নাম নেই কুষ্টিয়ার সাহেবনগর গ্রামের বাসিন্দাদের। শত শত লোক তাকিয়ে আছে প্রমত্তা পদ্মার দিকে। এতো দিনের ভালোবাসার নদীটি এখন গিলে ফেলতে হুমকি দিচ্ছে তাদের। ফসলি মাঠ, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন কিংবা ছোটবড় সড়ক আগেই গ্রাস করেছে, এবার ঘরবাড়ির পালা।

মিরপুর উপজেলার সাহেবনগর গ্রামের সামনে সভ্যতার প্রতিক হিসেবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের আরেকটি খুঁটি শনিবার বিলীন হয়েছে পদ্মার কড়াল গ্রাসে। এরপর থেকেই মূলত আতঙ্ক বেড়েছে ওই এলাকায়। গতমাসে প্রথম খুঁটিটি ধসে পড়ার পর কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ঘেরাও করেন বাসিন্দারা। এরপর নামমাত্র কিছু জিও ব্যাগ ও টিউব ব্যাগ ফেলা হলেও তা ভাঙন রোধে কোনো কার্যকর উপায় নয় বলে মনে করছেন তারা।

সাহেবনগর গ্রামের করিম বিশ্বাস একটি চৌকির ওপর চায়ের দোকান দিয়ে বসে আসেন। ভাঙন দেখতে আসা মানুষেরা তার দোকানেও ভিড় জমাচ্ছেন। সেখানে চায়ের আড্ডায় করিম বিশ্বাস বলেন, যখন আমার ৬ বিঘা ধানী জমি একসঙ্গে নদীতে চলে গেল, সেদিন আমার ছেলে ফিরে এসে বলে লেখাপড়া আর হবে না। আমি ইটভাটায় কাজে গেলাম। সেই কথা এখনো বুকে কাঁটা হয়ে বিঁধে আছে। করিমের এই গল্পে যখন উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ, তখন পাশেই উচ্চস্বরে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘আমার মাটি আমার মা, বিলীন হতে দেবো না।’

সেখানে চলছিল সাহেবনগর নদী ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সংবাদ সম্মেলন। এলাকার চুনু মোল্লা মাইকে বলছেন, দুপুরে যখন বড় পাঁক এসে টাওয়ারটা ভেঙে নিয়ে গেল, এরপর থেকে একমুঠ ভাতও মুখে দিতে পারিনি। নদীর ভাঙন দেখেই পেট ফুলে উঠছে। আমার বাড়ি থেকে মাত্র ১০ হাত দূরে নদী। রাতে ঘুমাতেও পারব না।

এমনই নির্ঘুম রাত কাটছে সাহেবনগরসহ আশপাশের বিস্তৃর্ণ এলাকার হাজারো মানুষের। সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা জানান, নদীর উল্টোপাশে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর থেকে এই পাশে ভাঙন শুরু হয়েছে। সাহেবনগর নামে যে গ্রামে সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে, একসময় সেখান থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূর দিয়ে প্রবাহিত হতো পদ্মা। এখন ভাঙতে ভাঙতে তাদের দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে প্রমত্ত এই নদী।

সাহেবনগর নদী ভাঙন প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক মেহেদী হাসান অপু বলেন, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নদীর ভেতর ব্যারেজ করা হয়েছে। এতে যে পানি পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হতো, সেই পানি এখন উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। মিরপুর উপজেলা বহলবাড়িয়া ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন বসতবাড়ি রক্ষায় আমরা আন্দোলন করছি।

নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে মেহেদী বলেন, দাবি নিয়ে আমরা ঢাকাতে গিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজিকে স্মারকলীপি দিয়েছি। কিন্তু কোনো উদ্যোগ এখনো দেখতে পাচ্ছি না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, প্রতিনিয়ত ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করছি। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গেই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। পানি স্টাবল না হলে কাজ কোথায় শুরু হবে, তা ঠিক করা যাচ্ছে না।