রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভুল ও বিতর্কিত অবস্থান

তাবাসসুম জেরিন

দেশভাগ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, এ অঞ্চলে শতাব্দির দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান ছিল বিতর্কিত ও ঐতিহাসিক ভুল। দলটির ইতিহাস ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল বিভাজনের। অস্থিরতা ও সহিংসতা তৈরির অভিযোগও রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে। বিশেষ করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর বিরোধিতা এখনো বাংলাদেশিদের মনে দাগ কেটে রয়েছে। এরপর নিষেধাজ্ঞা ও রাজনীতিতে ফেরার দীর্ঘদিন পর ২০০৬-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রেক্ষাপটেও জামায়াতের ভূমিকা ছিল সমালোচিত।

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে জামায়াতে ইসলামী হিন্দ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। জামায়াত ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল। জামায়াত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় দল মুসলিম লীগকে সমর্থন করেনি। ইংরেজ শাসনের অবসান ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের শাখা থেকে সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। মওদুদীসহ ৬০ জামায়াত নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ওই বছর অক্টোবরেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় দফা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সরকার সব ধরনের রাজনৈতিক দলের রাজনীতি উন্মুক্ত করে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে তারা পুনরায় রাজনীতির মঞ্চে ফিরে আসে। দলটির মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং এর জন্য তারা নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে থাকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে জামায়াতসহ অন্যান্য দলগুলো ব্যাপক সহিংসতা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। জামায়াত ও তাদের জোটসঙ্গী দলগুলো বিভিন্ন আন্দোলন, হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করে, যা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে। ওই সময় জামায়াতের রাজনৈতিক সহিংসতা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ নষ্ট করতে সহায়তা করেছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে, জামায়াত-শিবির তার বিরোধিতা করে সহিংস বিক্ষোভে অংশ নেয়। তারা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে সরকারি স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে এবং সাধারণ জনগণকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কিছু অংশ সশস্ত্র সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা রেলপথ ধ্বংস, গাড়ি পোড়ানো এবং বোমা হামলার মতো নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে, যা দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
জামায়াতের রাজনৈতিক কৌশল ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং আগ্রাসী। তারা ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করে তারা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করতে চেয়েছিল এবং ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এর ফলে দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তী নির্বাচিত সরকার জামায়াতের সহিংস কার্যক্রম দমনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হলে দলটি আর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে সক্ষম হয়নি।
বর্তমান বাংলাদেশে আবারও জামায়াতের কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক কৌশল ও আগ্রাসী মনোভাব দেশের গণতন্ত্র এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ২০১৩ সালে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর দলটি সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও, সাম্প্রতিক সময়ে তারা পুনরায় রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয়।
সর্বশেষ ৫ আগস্ট পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর ওই মাসেই ইউনুস সরকার জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। এরপরও বিতর্কিত পেছন ছাড়েনি জামায়াতে ইসলামীর। তাদের বর্তমান রাজনৈতিক কৌশল ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে ফেলছে। দলটি কি পারবে তাদের ভুল রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সৃষ্টিশীল উপায়ে নিজেদের উপস্থাপন করতে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত।