ইতিহাসের পাতাজুড়ে যার গৌরব-ঐতিহ্য
কুষ্টিয়া উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন জেলাগুলোর একটি। হ্যামিলটনের গেজেটিয়ারে বর্ণিত এ পাললিক ভূখণ্ড সময়ের পরিক্রমায় অতিক্রম করছে নানামুখী ইতিহাস; বয়ে নিয়ে চলেছে এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। বিভিন্নভাবে সম্পর্কযুক্ত এসব বিষয় কুষ্টিয়াকে দিয়েছে ইতিহাসের একটি অত্যুজ্জ্বল ঐতিহ্যগত মাত্রা। বহুকাল আগে থেকেই বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতির ধারাকে নানাভাবে প্রতিনিধিত্ব, প্রভাবিত ও সমৃদ্ধ করে আসছে এ জেলা। এরই মধ্যে জেলাটি দেশ ও দেশের বাইরে ‘সংস্কৃতির জনপদ’ (বহুল ব্যবহূত ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’) নামে খ্যাতি অর্জন করেছে। আরো মূল্যবান যে বিষয়টি তা হলো দেশের প্রমিত ভাষাতাত্ত্বিক যে লোকজ ঐতিহ্য সেই মূলধারায় কুষ্টিয়ার অবদান স্বীকৃত।
নামকরণ
আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের সূত্র ধরে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা পাকিস্তানের অংশ হয়ে পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। তার আগে ছিল মহকুমা হিসেবে অবিভক্ত বাংলার প্রেসিডেন্সি বিভাগের অন্যতম নদীয়া জেলার অংশ। পেছনে রয়েছে আরো ইতিহাস।
ইতিহাসবিদ কুমুদনাথ মল্লিক তার ‘নদীয়া কাহিনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘কুষ্টিয়া জেলার প্রাচীন ইতিহাস জানা যায় না।’ কুষ্টিয়া নামকরণেও প্রচলিত নানা কথা। ১৮২০ সালে হ্যামিলটনের গেজেটিয়ারে উল্লেখ আছে যে স্থানীয় জনগণ একে ‘কুষ্টি’ বলে ডাকত, সেজন্য নাম হয়েছে কুষ্টিয়া। অনেকের মতে ফারসি শব্দ ‘কুশতহ’ যার অর্থ ‘ছাই দ্বীপ’ থেকে কুষ্টিয়ার নামকরণ হয়েছে। এ অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে ‘কুষ্টা’ (পাট) জন্মায় বলে এ নামের সৃষ্টি হতে পারে। সম্রাট শাহজাহানের (১৫৯২-১৬৬৬) আমলে স্থানটি গড়ে উঠেছিল পাট ব্যবসাকেন্দ্রিক নৌবন্দর হিসেবে এবং ওই সময় কুষ্টি বন্দরকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়া শহরের উত্পত্তি ঘটেছে। পাটের স্থানীয় পরিভাষা এখনো কুষ্টা। অনেকে মনে করেন, কুষ্টা থেকে কুষ্টিয়া নামের উত্পত্তি। কুষ্টিয়া নামকরণের ব্যাপারে বেশকিছু যুক্তি আছে। এ জেলার অনেক মানুষ এখনো কুষ্টিয়াকে ‘কুইষ্টে’ বা ‘কুষ্টে’ বলে অভিহিত করে। তাই ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে কুষ্টে শব্দ থেকে কুষ্টিয়া নামটি এসেছে। ইতিহাস বলছে, এ অঞ্চলের ও অবিভক্ত নদীয়া জেলার আদি বাসিন্দাদের মুখের ভাষার সঙ্গে আধুনিক প্রমিত বাংলার ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে। নদীয়া জেলায়ও এ মহকুমাকে ‘কুষ্টে’ বা ‘কুইষ্টে’ নামে ডাকার দীর্ঘ প্রচলন লক্ষ করা যায়।
কুষ্টিয়া জেলার রয়েছে সুদীর্ঘকালের ইতিহাস। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে টলেমির মানচিত্রে গঙ্গা নদীর অববাহিকায় কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ দেখা যায়, যেগুলোকে কুষ্টিয়া অঞ্চল মনে করা হয়। তবে কুষ্টিয়া কোনো প্রাচীন নগর নয়; এটি একটি নদীবিধৌত পাললিক সমতট।
ভারতকোষ গ্রন্থে কুষ্টিয়া অঞ্চল সম্বন্ধে বলা হয়েছে: ‘নদীবিধৌত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলের পলিগঠিত সমভূমিতে অবস্থিত বলিয়া ইহার মৃত্তিকা অত্যন্ত উর্বর ও কৃষির পক্ষে উপযোগী।’ সুতরাং কৃষি উপযোগী ভূমি আর অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিলে প্রচুর মত্স্য—এ দুটির আকর্ষণেই যে এ অঞ্চলে কৃষিজীবী ও মত্স্যজীবী সম্প্রদায়ের আগমন ঘটেছিল এ অনুমান যুক্তিসংগত। খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষে এবং চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমভাগে পূর্ব বাংলায় সমতট ও পশ্চিম বাংলায় পুস্করণ রাজ্য অথবা পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্ত শাসনামলে কুষ্টিয়া অঞ্চলের কোনো ইতিহাস জানা যায় না; অষ্টম শতাব্দীতেও এ অঞ্চলের ইতিহাস অজ্ঞাত। বাংলাদেশে সমতট, বঙ্গ ও গৌড়—তিনটি রাজ্যের শাসনামলে কুষ্টিয়া অঞ্চল কোনো সময়ে সমতট আবার কোনো সময়ে গৌড়ের শাসনভুক্ত ছিল। এ তিনটি রাজ্যের সীমা নির্ণয়ে ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেননি। রাজা শশাঙ্কের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজক যুয়ান চুয়াং বাংলাদেশ ভ্রমণ করে যে বিবরণ দিয়ে গেছেন তা থেকে জানা যায় যে তত্কালীন বঙ্গরাজ্য, কামরূপ, পুণ্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, সমতট ও তাম্রলিপি—পাঁচ ভাগে বিভক্ত ছিল। কুষ্টিয়া অঞ্চল সপ্তম শতাব্দীতে শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল বলে অনুমিত হয়। শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের সীমান্ত থেকে কয়েক মাইল দূরে মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত ছিল। কোনো রাজা রাজ্যের সীমান্তে রাজধানী স্থাপন করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। সমতট রাজ্যটি যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে গঠিত ছিল। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় আবিষ্কৃত শিলালিপি থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে দক্ষিণবঙ্গে মহারাজাধিরাজ গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য ও নরেন্দ্রাদিত্য সমাচারদের নামে তিনজন রাজার রাজত্ব করার কথা জানা যায়। ধর্মাদিত্যের একটি তাম্রশাসনে জানা যায়, তার রাজত্বকালে গৌড়ের অংশবিশেষের রাজা ছিলেন স্থানদত্ত। এ ‘গৌড়ের অংশবিশেষ’ স্থান কুষ্টিয়া অঞ্চল ছিল বলে মনে করা হয়। অষ্টম শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালবংশের রাজত্ব ছিল। পাল রাজত্বের অবসানকাল (দশম শতাব্দীর শেষাংশ) পর্যন্ত এ অঞ্চল পাল রাজ্যভুক্ত ছিল বলেই অনুমিত। দশম শতাব্দীর শেষে ও একাদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজত্বের অবসান পর্বে কয়েকজন সামন্তরাজ কর্তৃক কুষ্টিয়া অঞ্চল কিছুকালের জন্য বিক্রমপুর-হরিকেলে স্থাপিত চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। কুমার নদ কুষ্টিয়া জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল। কুষ্টিয়া অঞ্চল পরিত্যাগ করলেই তার নাম হয়েছিল মধুমতি। সুতরাং কুষ্টিয়া অঞ্চল বাংলায় সেন রাজত্ব প্রতিষ্ঠার আগে বিক্রমপুর-হরিকেলের চন্দ্রবংশীয় রাজাদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিষয়টি সমর্থনযোগ্য।
দশম শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভারতের কর্ণাটক থেকে আসা চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজা সামন্ত সেন বাংলায় সেন রাজাবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার সেন রাজবংশের প্রায় পৌনে দুইশ বছর শাসনকালে কুষ্টিয়া জেলাঞ্চল তাদের শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতকোষে উল্লেখ করা হয়েছে ‘পূর্বকালে ইহা (কুষ্টিয়া-লে.) সেনরাজগণের রাজত্বাধীন ছিল।’ লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে ১২০৪ সালে বিহার থেকে ঝাড়খণ্ডের পথে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি নামে একজন তুর্কি মুসলিম সেনাপতি মাত্র ১৭ অথবা ১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী নদীয়া দখল করেন। বখতিয়ার নদীয়া দখল করে গৌড়ে গমন করেন। সেখান থেকে তিনি তিব্বত অভিযান করে ব্যর্থ হয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলে আলী মর্দান খিলজি নামে তার এক পার্শ্বচর কর্তৃক ১২০৬ সালে নিহত হন। বখতিয়ার খিলজির নদীয়া বিজয়ের পর কুষ্টিয়া অঞ্চল মুসলিম শাসনে এসেছিল, কিন্তু কোনো স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারেনি। তার নদীয়া বিজয়ের ৫০ বছর পর মুগীসউদ্দিন য়ুজরুক পুনরায় নদীয়া দখল করেন। নদীয়ায় বাংলার প্রথম মুসলিম শাসনের যে সূত্রপাত হয় তা প্রায় ৬০০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। সেন রাজত্বকালের বিশেষ কোনো স্মৃতিচিহ্ন কুষ্টিয়া অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয়নি। মেহেরপুর মহকুমার আমদহের মাঠে এ আমলের একটি মন্দিরের স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নদীয়ায় যে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটেছিল তাই ক্রমেই বিস্তার লাভ করে বাংলার বর্তমান মুসলিম ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম সুলতানি আমলের স্মৃতিচিহ্ন কুষ্টিয়া জেলায় একরূপ নেই বললেই চলে। সদর মহকুমার মাধবপুর গ্রামে আবিষ্কৃত সুলতান শামস্উদ্দিনের পিতা সুলতান-উস-সালাতিন সাইফুদ্দিনের (পিতা সুলতান গিয়াসউদ্দিন) নামাঙ্কিত (১৩৭৩-১৩৮৩ সাল পর্যন্ত রাজত্বকাল) কয়েকটি মুদ্রা পাওয়া যায়।৯ ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’র দেওয়ানি লাভ পর্যন্ত ৫৬২ বছরে মোট ৭৬ জন সুবেদার, নাজিম, রাজা ও নবাব বাংলাদেশ শাসন করেছেন, কুষ্টিয়া তাদের প্রায় সবারই শাসনের অন্তর্গত ছিল। এ শাসকদের ১১ জন সুবেদার ঘোরি ও খিলজি, সুলতানদের মনোনীত ২৬ জন স্বাধীন শাসনকর্তা (এর মধ্যে শের শাহর আমলের শাসকরা আছেন), অবশিষ্ট ৩৪ জন মোগল সম্রাটদের মনোনীত। পাঁচজন স্বাধীন রাজার মধ্যে রাজা গণেশ, জালালউদ্দিন (যদু), শামস্উদ্দিন আহমদ শাহ রয়েছেন। এ পাঁচজন এবং রাজা তোডরমল ও রাজা মানসিংহ বাদে প্রায় সব সুবেদারই আফগান, ইরানি অথবা মোগল ছিলেন। গৌড়রাজ গিয়াসউদ্দিন আযম শাহর আমলে (১৩৮৪-১৪০৯) গৌড়ের রাজস্ব ও শাসন বিভাগের কর্মকর্তা ভাতুরিয়া পরগনায় (রাজশাহীতে অবস্থিত) জমিদার রাজা কংস বা গণেশ গৌড় দখল করে স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। রাজা গণেশ রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে তার পুত্র যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। জালালউদ্দিন যদুর মৃত্যুর পর তার পুত্র সুলতান শামস্উদ্দিন আহমদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার সময়ে কুষ্টিয়া অঞ্চল তথা দক্ষিণবঙ্গে ইসলাম ধর্ম প্রচার ব্যাপকভাবে শুরু হয়। শামস্উদ্দিন আহমদ শাহকে হত্যা করে ইলিয়াস শাহী বংশের নাসিরউদ্দিন মহম্মদ শাহ গৌড় সিংহাসন দখল করেন। সুলতানি আমলে কুষ্টিয়া খল-বিল-নদ-নদীতে পূর্ণ একটি উর্বর সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল। সামন্ত রাজারা রাজত্ব আদায়, বিচার আচার ইত্যাদি সব বিষয়ে ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
মোগল ও তত্পূর্বের শাসনামল বিবেচনায় কুষ্টিয়া জেলার প্রাচীন ইতিহাস জানা যায় না অথবা অনুমাননির্ভর-কষ্টসাধ্য। জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ১৫২৬ সালে দিল্লির কাছে পানিপথের যুদ্ধে পাঠান সুলতান ইব্রাহীম লোদিকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকালে বাংলাদেশে দীর্ঘকাল পাঠান-মোগল লড়াই চলেছিল। মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রথম পর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে বারভূঁঞা বা সামন্ত রাজারা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। আকবরের সময় বাংলাদেশে যখন মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠা চলছিল, সে সময় মোগল সেনাপতি ‘মাসুম খান কাবুলি’ ফতেহাবাদ পরগনার মজলিস কুতুবের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য গড়ে তোলার প্রয়াস পান। ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে কুষ্টিয়ার অধিপতি ছিলেন বিদ্রোহী এ মোগল সেনাপতি মাসুম খান কাবুলি। তিনি ঈশা খাঁ, উসমান ইত্যাদি বারভূঁঞার সঙ্গে মিলিত হন। তিনি নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ বলে ফরমানে উল্লেখ করেন। তার মৃত্যুর পর তার পুত্র মির্জা মুনীম ফতেহাবাদের (বর্তমানে ফরিদপুর) জমিদার মজলিশ কুতুবেরর সঙ্গে মিলিত হয়ে আবারো মোগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অবশেষে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমে মোগল সেনাপতি শেষ হাবিবুল্লা, মির্জা মুনীম ও মজলিশ কুতুবকে পরাজিত করে কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। মোগল আমলে মূল কুষ্টিয়া ছিল সরকার ফতেহাবাদ ও সরকার ভূষণার (যশোহর) অন্তর্ভুক্ত এবং পরগনা ফতেহাবাদ (ফরিদপুর জেলার রাজবাড়ী অঞ্চল) বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। পরগনা ফতেহাবাদে মোগল-পাঠান সংঘর্ষের সময় কুষ্টিয়ার বাগোয়ান পরগনা সম্পূর্ণ মোগল অধিকারভুক্ত ছিল। মোগল নৌবহরে অধ্যক্ষ মীর্জা নাথানের ‘বাহিরিস্তান-ই-গায়েবী’ গ্রন্থে জানা যায় যে বাংলার বারভূঁঞাদের অন্যতম যশোরাধিপতি রাজা প্রতাপাদিত্য রায় গড়াই নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও ২৪ পরগনা অঞ্চল নিয়ে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। কুষ্টিয়ার মাহাদপুর-বাগোয়ান অঞ্চলে দ্রুত শাসক বদল থেকে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক গুরুত্ব প্রমাণ হয়। কুষ্টিয়া অঞ্চলে মোগল নৌবাহিনীর ঘাঁটি থাকায় এ অঞ্চলের নদ-নদীর অবস্থা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে দিল্লির সম্রাটের অধীনে রাজা মান সিংহ পরিচালিত মোগলদের লড়াই পরিচালিত হয়েছে বাগোয়ান মাহাদপুর মোগল নৌঘাঁটি থেকেই, যে যুদ্ধে প্রতাপাদিত্য পরাজিত হন। এ অঞ্চলের সামন্ত শাসকরা মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করায় মোগল বাহিনী তাদের বিভিন্ন সময় দমন করে।
বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর শাসনকালে কুষ্টিয়া, যশোর অঞ্চলে রাজা সীতারাম ১৭১১ সালে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি যশোরের মাগুরার নিকটবর্তী মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। রাজা সীতারামের রাজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় সাত হাজার বর্গমাইল। তার মধ্যে প্রায় এক-ষষ্ঠাংশ অঞ্চল ছিল কুষ্টিয়া জেলায়। তার রাজ্যের বেলগাছি, শাহ উজিয়াল, মকজায়গীর, নছরতশাহী, হিংলী, নাসিরশাহী, ভড় পতেজঙ্গপুর প্রভৃতি পরগনা অথবা তার অংশবিশেষ ছিল কুষ্টিয়া জেলায়। ১৭১৪ সালে রাজা সীতারামের সেনাপতি ‘মেনাহাতি’ নবাব সেনাপতি হাসান খানের কাছে পরাজিত হলে সীতারাম বন্দি হন এবং মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। ১৭১৫ সালে রাজা সীতারাম মুর্শািদাবাদ নবাবের কারাগারে বিষপানে আত্মহত্যা করেন। সীতারামের মৃত্যুর পর তার জমিদারি এলাকা নবাবের শাসনাধীনে আসে। নদীয়ার বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র ১৭২৮ সালে নদীয়ার গদিতে বসেন। তিনি রাজা সীতারামের রাজ্যের কিছু অংশ লাভ করেন। তার রাজ্য এলাকায় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর মহকুমা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি হিন্দু ধর্মে অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। কথিত আছে, তিনি কালী পূজা, দীপালি প্রদান প্রথা প্রচলন করেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ সময়মতো খাজনা দিতে না পারায় কৃষ্ণ চন্দ্রকে বন্দি করেন। নির্দিষ্ট দিনে খাজনা পরিশোধ করতে না পারলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে বলে নবাব আদেশও প্রদান করেন। এতমাবস্থায় সমুদ্রগড়াধিপতি তার জমিদারির খাজনা দিয়ে রাজাকে মুক্ত করে নিজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর সরফরাজ খাঁ নবাব হন। বাংলার স্বাধীন নবাব আলীবর্দি খাঁ (শাসনামল ১৭৪০-৫৬) সরফরাজ খাঁকে যুদ্ধে পরাজিত করে তার স্থলাভিষিক্ত হন। ১৭৫৬ সালে নানা আলীবর্দি খাঁর মৃত্যু হলে দৌহিত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার স্বাধীন নবাব হিসেবে মসনদে আসেন। ১৭৫৭ সালে পলাশী আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফর চক্রের যে প্রহসন যুদ্ধ হয়, তাতে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র ব্রিটিশ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভের পক্ষ সমর্থন করেন। লর্ড ক্লাইভ যুদ্ধে জয়লাভের পর তাকে ‘রাজরাজেন্দ্র বাহাদুর’ খেতাব এবং ১২টি কামান উপহার প্রদান করেন। নদীয়া বংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদার রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মোগলদের সহায়তা এবং রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সহায়তা করার মতো বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ইতিহাসে নিন্দিত।
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করলে নদীয়া তাদের শাসনাধীনে আসে। নদীয়া প্রাচীনকাল থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিশেষ খ্যাত ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশ থেকে বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু নরপতি লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী ছিল নদীয়া। আর মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে মেহেরপুরে বাগোয়ানের ভবানন্দ মজুমদার যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন তা ‘নদীয়া রাজবংশ’ নামে পরিচিত হয়। নদীয়ারাজের জমিদারি এলাকা ছিল ৩ হাজার ১৫১ বর্গমাইল এবং তা বর্তমান পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার সদর ও রানাঘাট মহকুমার দক্ষিণ অঞ্চল, মেহেরপুর মহকুমার কিছু অংশ, যশোরের বনগাঁ ও যশোর সদরের দক্ষিণ-পূর্বাংশ, খুলনা জেলার পশ্চিম সাতক্ষীরা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৭৯৬ সালে নদীয়া ও যশোরের সীমানা নির্দিষ্ট হলেও পরে বহুবার উভয় জেলার সীমানা পরিবর্তন হয়েছে। যশোরের সঙ্গে নদীয়া ও কুষ্টিয়া জেলার সীমানাও পরিবর্তন হয়েছে। ১৮০২ সালে আনওয়ারপুর জমিদারি চব্বিশ পরগনা জেলায় এবং ১৮১২ সালে টাকি ও সুখসাগর থানা যশোর থেকে নদীয়ায় যুক্ত হয়। ১৮২৩ সাল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকা যশোর জেলার অংশ হিসেবে শাসিত হয়েছে। ১৮৬৩ সালে পাবনা থেকে কুষ্টিয়া মহকুমা এবং ১৮৭১ সালে কুমারখালী মহকুমা নদীয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৮২৭ সালে খোকসা থানা যশোর থেকে পাবনার সঙ্গে এবং ১৮৭১ সালে তা নদীয়া জেলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। কুষ্টিয়া শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮২০ সালে প্রকাশিত হ্যামিলটনের ইস্ট ইন্ডিয়া গেজেটিয়ারে। এ সময় পদ্মা নদী কুষ্টিয়ার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হতো। আদি কুষ্টিয়া বর্তমান শহরের থেকে তিন মাইল উত্তরে অবস্থিত ছিল। ওই স্থান বর্তমানে পুরাতন কুষ্টিয়া নামে পরিচিত। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হলে মজমপুর ও বাহাদুরখালী মৌজা নিয়ে পাট বিক্রির আদি প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে কুষ্টিয়া শহর গড়ে ওঠে। নীলকরদের ওপর নজর রাখার উদ্দেশ্যে ১৮৬০ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা স্থাপিত হয়। বাংলার তদানীন্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন পিটার গ্রান্ট নীল বিদ্রোহজনিত কারণে ১৮৬০ সালে কলকাতা থেকে সোনামুখী জাহাজ যোগে কুষ্টিয়ার কুমার নদপথে জেলা সদর পাবনা গমন করেন এবং পাবনার নীলচাষী সমাবেশে তিনি কুষ্টিয়া অঞ্চলের প্রজাদের পাবনা গমনে অসুবিধা দূর করার জন্য কুষ্টিয়া মহকুমা প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেন। তার আগে কুষ্টিয়া ছিল একটি থানা এবং তা মজমপুর গ্রামে অবস্থিত ছিল। উল্লেখ্য, ১৮২৮ সালে পাবনা জেলা প্রতিষ্ঠার সময় কুষ্টিয়া থানা পাবনার অন্তর্ভুক্ত হয়। পাবনা জেলা গঠিত হওয়ার আগে মেহেরপুরের কিছু অংশ বাদে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার অধিকাংশ অঞ্চল রাজশাহী জমিদারি এলাকা ছিল। ১৮৫৭ সালে ফরিদপুর জেলার পাংশা ও বালিয়াকান্দি থানা এবং পাবনা জেলার খোকসা ও কুমারখালী নিয়ে কুমারখালী মহকুমা প্রতিষ্ঠা করে পাবনা জেলাভুক্ত করা হয়। কুমারখালী মহকুমার প্রথম মুন্সেফ নিযুক্ত হন ঈষাণ চন্দ্র দত্ত। ১৮৬২ সালে কুষ্টিয়া মহকুমার কাজ আরম্ভ হলেও কুষ্টিয়া মহকুমা নদীয়া জেলাভুক্ত হয় ১৮৬৩ সালে। ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে কুষ্টিয়ার পৌরসভা। ১৮৭১ সালে কুমারখালী ও খোকসা থানা কুষ্টিয়া মহকুমাভুক্ত করে নদীয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। পাংশা ও বালিয়াকান্দি থানা ১৮৭১ সালেই ফরিদপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। নদীয়া জেলার সদর ছিল কৃষ্ণনগরে। কুষ্টিয়া অঞ্চলের সাধারণ লোক কৃষ্ণনগরকে গোয়ারী বলত। কুষ্টিয়া মহকুমায় থানা ছিল যথাক্রমে কুষ্টিয়া, কুমারখালী, ভালুকা, ভাদালিয়া, নওপাড়া ও দৌলতপুর। ভেড়ামারা থানা পরে স্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে কুষ্টিয়া, কুমারখালী, ভেড়ামারা, মিরপুর, দৌলতপুর ও খোকসা থানা নিয়ে কুষ্টিয়া মহকুমা গঠিত হয়। কুমারখালীতে থানা প্রতিষ্ঠার আগে ভালুকায় থানা ছিল। ভালুকা থানা কুমারখালী থানার অন্তর্ভুক্ত। পোড়াদহে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা চৌকি ছিল। ভাদালিয়াতেও নবাবি আমলে চৌকি ছিল। ১৮৬২ সালে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরে মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। কেউ কেউ অনুমান করেন, মেহেরপুর মহকুমা ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আগে চুয়াডাঙ্গার সদর ছিল দামুড়হুদায়। পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ১৮৭১ সালে এ মহকুমাকে নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেললাইন খোলা হলে মহকুমার সদর অফিস চুয়াডাঙ্গায় স্থানান্তরিত হয়। বিখ্যাত ভারতহিতৈষী সিভিলিয়ান স্যার হেনরি কটন ১৮৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গার মহকুমা হাকিম ছিলেন। তারই উদ্যোগে চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হয়। ১৮৮৭ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া জুবিলি উপলক্ষে ১৮৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত কুষ্টিয়া হাইস্কুলে একাডেমিক ভবন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ পূর্ণাঙ্গ হাইস্কুল যুক্ত করা হয়। যাতায়াতের অসুবিধার কারণে জনসাধারণ আপত্তি করলে ১৮৯৭ সালের ১৫ মার্চ চুয়াডাঙ্গা মহকুমা পুনরায় স্থাপন করা হয়। তখন অবিভক্ত নদীয়া জেলার মহকুমা হয় কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়া এবং আয়তন ২ হাজার ৮৪১ বর্গমাইল। তার মধ্যে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার আয়তন ১ হাজার ৩৭১ বর্গমাইল আর পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার আয়তন ১ হাজার ৪৭০ বর্গমাইল। পশ্চিম বাংলার সঙ্গে কুষ্টিয়া জেলার ১৩২ মাইল সীমান্ত রেখা রয়েছে। দেশ বিভাগের পর বহু হিন্দু কুষ্টিয়া ত্যাগ করে ভারত চলে যাওয়ায় এখানে শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য নানা অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। তেমনি পশ্চিম বাংলা থেকে বহু মুসলমান পরিবার ও বিহারি সর্বস্ব হারিয়ে কুষ্টিয়ায় আসায় তাদের পুনর্বাসন ও জীবিকার ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।
১৯৪৬ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনে অবিভক্ত নদীয়া জেলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা হিসেবে পরিগণিত হয় কুষ্টিয়া। ১৯৪৭ সালের জুনে ‘সর্বভারতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠিত হলে অবিভক্ত বাংলাদেশকে হিন্দু ও মুসলিমপ্রধান এলাকা হিসেবে বিভক্ত করা হয়। এ বিভাগকে ‘জাতীয় বিভাগ’ বলা হয়। জাতীয় বিভাগ অনুসারে মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোকে পূর্ববঙ্গ এবং হিন্দুপ্রধান জেলাগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। সে কারণে নদীয়া ও মুর্শিদাবাদ জেলার মুসলমানরা পাকিস্তানভুক্তির আশা করেছিলেন। কিন্তু দেশ বিভাগের সময় নদীয়া জেলার অর্ধেকের বেশি এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
১৯৪১ সালের আদমশুমারি অনুসারে নদীয়ার মুসলমানের সংখ্যা ৬১.২৫, হিন্দু ৩৭.৬৮ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ১.৩৭ শতাংশ। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাকিস্তান ও ভারত রাষ্ট্রের সীমানা কমিশন ঘোষণা করেন। অবিভক্ত বাংলাদেশ বিভক্তির জন্য যেসব ব্যক্তি নিয়ে ‘বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশন’ গঠিত হয় তারা হলেন স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, জাস্টিস আবু সালেহ মহম্মদ আকরাম সদস্য ভারত, জাস্টিস সিসি বিশ্বাস সদস্য ভারত। বেঙ্গল বাউন্ডারি কমিশনের সদস্যরা স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের অনুপস্থিতিতে কলকাতার বেলভেদার হাউজে কয়েকবার অধিবেশনে মিলিত হলেও সীমানা চিহ্নিতকরণে ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হন। তখন সদস্যরা চেয়ারম্যান র্যাডক্লিফকে বিলেত থেকে কলকাতায় আসার অনুরোধ করেন। স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ ভারতে এসে উভয় পক্ষের সদস্যদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই তার রিপোর্ট প্রদান করেন। দেশভাগ হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, কিন্তু র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষিত হয় ১৬ আগস্ট। এ কারণে কৃষ্ণনগরে ও রানাঘাট মহকুমার মুসলমানরা সম্পূর্ণ নদীয়া জেলা পাকিস্তান হয়েছে মনে করে বিপুলভোটে ‘পাকিস্তান দিবস’ পালন করেন। নদীয়ার তদানীন্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষ্ণনগরে মুসলিম লীগের পতাকাও উত্তোলন করেন।
র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে অবিভক্ত নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর সদর, রানাঘাট মহকুমা ও মেহেরপুরের সদর থানা ও গাংনী থানা এবং কুষ্টিয়া মহকুমা পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ রোয়েদাদে বাংলাদেশে সীমানা চিহ্নিতকরণে অসুবিধা দেখা দেয়ায় আলগট ব্যাগি (চেয়ারম্যান), জাস্টিস শাহাবউদ্দিন (প্রতিনিধি পাকিস্তান), জাস্টিস চন্দ্রশেখর আয়ার (প্রতিনিধি ভারত) ব্যক্তিদের নিয়ে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। ১৯৫০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাগি কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়: The line shall then turn South-East down the river Ganges to the point in the North-West corner of the districts of Nadia where the channel of the river Mathabhanga takes off from the river Ganges. This line shall then run along that channel to the northern-most point where it meets the boundary between the main channels shall constitute the atual boundary. From this point the boundary between East & West Bengal shall run along the boundaries between the thanas of Daulatpur & Karimpur, Gangni and Karimpur, Meherpur and Tehatta, Meherpur and Chapra, Damurhuda and Chapra, Dhamurhuda and Krishnaganj, Jibannagar and Krishnaganj, Jibonnagar and Kanskhali, Meherpur and Ranaghat, Meherpur and Bonagoan and so on.
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর মহকুমার কিছু অংশ নিয়ে নবগঠিত জেলার নাম রাখা হয় ‘নদীয়া’ আর পশ্চিম বাংলার বর্তমান নদীয়া জেলার নাম রাখা হয় ‘নবদ্বীপ’। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় তত্কালীন ভারতের অবিভক্ত নদীয়া জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান (১৯৪২-৪৭) বিশিষ্ট মুসলিম নেতা খান বাহাদুর সামসুজ্জোহা নদীয়া জেলা বোর্ডের কাছ থেকে দাবি জানিয়ে সম্পদ ভাগাভাগি করে কুষ্টিয়ায় নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, তিনি ১৮৯৯ সালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মির্জাপুর (গোদাপাড়া) গ্রামে জন্মেছিলেন। নবগঠিত নদীয়া জেলার বর্তমান কুষ্টিয়ার প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন নাসির উদ্দিন আহমেদ। তিনিই নবগঠিত জেলার নাম নদীয়া রাখেন, কিন্তু দেশ বিভাগের পরবর্তী একটি মহকুমার শহরকে জেলা শহরে রূপ দেয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারি অফিস-আদালত ও সরকারি কর্মচারীদের বাসস্থান সমস্যা মেটানোর জন্য বহু লোকের বসতবাড়ি জরবদখল নেয়া হয়। কুষ্টিয়া হাইস্কুল তুলে দিয়ে দীর্ঘকাল পুলিশ লাইন করে রাখা হয়। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুর্তাজা আলী প্রশাসনিক কাজের অসুবিধা ও চিঠিপত্র আদান-প্রদানে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ায় নদীয়া নাম পরিবর্তন করে ‘কুষ্টিয়া’ রাখেন। তত্কালীন এসডিও মৌলবি আব্দুল বারী বিশ্বাসকে প্রধান করে কুষ্টিয়ায় ১৯৫৪ সালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। অতঃপর আরো বেশকিছু সরকারি অফিস কুষ্টিয়ায় স্থাপনের পর শহরটিতে পুনরায় উন্নয়ন শুরু হয়।
তথ্যসূত্র:
১. কুষ্টিয়ার ইতিহাস, শ ম শওকত আলী
২. নদীয়া কাহিনী, কুমুদিনী মল্লিক, (সম্পাদনা মোহিত রায়)
৩. ভারতকোষ, দ্বিতীয় খণ্ড
৪. আবুল আহসান চৌধুরী, কুষ্টিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য
২. কুষ্টিয়ার ইতিহাস, ড. মোহাম্মদ এমদাদ হাসনায়েন ও সারিয়া সুলতানা
শাহনাজ আমান: পরিচালক, কুষ্টিয়া পাবলিক স্কুল ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক কুষ্টিয়া